দ্বান্দিকতা কোনো কল্পকাহিনী বা অতীন্দ্রিয়বাদী বিষয় নয়। এটি আমাদের চিন্তনপ্রক্রিয়ার বিজ্ঞান যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়েই সীমাবদ্ধ নয় কেবল, বরং তার থেকেও জটিল ও বিস্তীর্ণ বিষয় নিয়ে বোঝাপড়া করাই এর কাজ। দ্বান্দিকতা এবং প্রচলিত যুক্তিবিদ্যার মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটা সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতের মধ্যকার সম্পর্কের মত।
এখানে আমি সমস্যাটির সারবত্তা পুরোপুরি বাস্তব রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো৷ অ্যারিস্টোটলীয় যুক্তি পদ্ধতি অনুযায়ী যুক্তিবাক্য(Syllogism) শুরু হয় এই অনুমান থেকে যে, ক=ক বৈ কিছু নয়। এই স্বীকার্য বিচিত্র ধরণের মানব ক্রিয়া ও মৌলিক সাধারণীকরণের নীতি তৈরির ক্ষেত্রে একটি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আদতে “ক” কখনোই “ক” -এর সমান নয়। এটা প্রমাণ করা খুবই সহজ যদি আমরা এই দুটি বর্ণকে একটি লেন্সের নিচে রাখি৷ কেউ আপত্তি করে বলতে পারেন যে, বর্ণগুলোর আকার বা রূপ এখানে অপ্রাসঙ্গিক, উভয় বর্ণই একই বস্তু বা পরিমাণকে নির্দেশ করে, উদাহরণ হিসেবে এক কেজি চিনির কথা বলা যায়। এই আপত্তিটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক; কারণ এক কেজি চিনি কখনোই অন্য এক কেজি চিনির সমতুল্য নয়- আরো সূক্ষ্ম একটি পরিমাপক সর্বদাই উভয়ের অসমতাকে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে। কেউ আবার আপত্তি করে এটা বলতে পারে যে, কিন্তু এক কেজি চিনি সর্বদা এক কেজি চিনিই থাকবে বা সমভার সম্পন্নই হবে। এটাও সত্য নয়--- সকল বস্তুই নিরবচ্ছিন্নভাবে আকার, রং, ভর, ওজন প্রভৃতি বদলায়৷ একজন সফিস্ট হয়ত বলবে, এক কেজি চিনি 'কোনো একটি মুহূর্ত বিশেষে' এক কেজি চিনি হিসেবেই থাক।
এই "স্বতঃসিদ্ধ"-এর অত্যন্ত অনিশ্চিত বা সন্দেহজনক ব্যবহারিক মূল্যের কথা বাদ দিলেও এটা তাত্ত্বিক সমালোচনার সামনে অরক্ষিত। "মূহুর্ত" নামক শব্দটিক আমরা কিভাবে কল্পনা করবো? এটা যদি সময়ের অতি ক্ষুদ্র এক বিরামকাল হয়, তবে এক কেজি চিনি ওই মূহুর্তের মাঝে অবশ্যই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে। নাকি "মূহুর্ত" শুধুমাত্র একটি বিমূর্ত গাণিতিক ধারণা, যা সময়ের বাইরে অবস্থিত? কিন্তু সবকিছুই সময়ের মাঝে বিরাজ করে; অস্তিত্ব মানেই রূপান্তরের এক অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। ফলত সময় অস্তিত্বের এক মৌলিক উপাদান। একারণে, “ক” সমান “ক” - এই স্বতঃসিদ্ধটি জ্ঞাপন করে যে, একটি বস্তু সর্বদাই তেমন থাকবে, যদি না তা কখনো রূপান্তরিত হয়; আদতে অরূপান্তরিত বস্তুর কোন অস্তিত্বই নেই।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই ধরণের সূক্ষ্মতা নিরর্থক। কিন্তু, আদতে এই সূক্ষ্মতা চূড়ান্ত তাৎপর্য ধারণ করে। “ক” সমান “ক”, অন্য কিছুই নয়--- এই স্বতঃসিদ্ধ একদিকে যেমন আমাদের সমগ্র জ্ঞানের ভিত্তি, তেমনি আমাদের জ্ঞানে বিদ্যমান সকল ত্রুটিরও ভিত্তি এই স্বতঃসিদ্ধ। ত্রুটিহীনভাবে “ক” সমান “ক”' স্বতঃসিদ্ধটি কিছু সীমিত প্রেক্ষাপটেই ব্যবহার করা সম্ভব। যখন কোন বর্তমান ক্রিয়ার জন্য “ক” তে পরিমাণগত পরিবর্তন তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তখন আমরা ধরে নিতে পারি যে, “ক” সমান “ক”। এভাবেই সাধারণত ক্রেতা- বিক্রেতারা এক কেজি চিনিকে বিবেচনা করেন৷ আমরা সূর্যের তাপমাত্রাকেও একইভাবে কল্পনা করি৷ আমরা ডলার ক্রয় ক্ষমতাকে কিছুদিন আগেও এভাবেই চিন্তা করতাম। তবে একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে পরিমাণগত রূপান্তর গুনগত পরিবর্তনের আকার ধারণ করে। এক কেজি চিনির সাথে পানি আর কেরোসিন মিশ্রিত করলে, তা আর এক কেজি চিনি থাকে না৷ প্রেসিডেন্টের হাত স্পর্শ করা এক ডলার আর তখন এক ডলার থাকে না। সমাজবিজ্ঞান সহ জ্ঞানের সকল স্তরেই সবথেকে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সঠিক সময়ে ওই তাৎপর্যপূর্ণ মূহুর্তটি নির্ধারণ করা যখন পরিমানগত অবস্থা থেকে গুনগত রূপান্তর ঘটে।
প্রত্যেক শ্রমিকই জানে, দুটি সম্পূর্ণরূপে সমরূপ বস্তু তৈরি করা অসম্ভব৷ চাকায় ব্যবহৃত বিয়ারিং আংটাকে কৌণিকভাবে তৈরীর প্রক্রিয়ায় কোণের ক্ষেত্রে একটি নিদির্ষ্ট পরিমাণ বিচ্যুতি থাকাটা স্বাভাবিক, যদিও তা একটি বিশেষ মানের বাইরে যেন না যায় সেটি খেয়াল রাখা হয়। এই মানটিকে বলা হয় টোলারেন্স। টোলারেন্স এর নিয়ম অনুযায়ী, বিভিন্ন কোণকে সমান মনে করা হয় ("ক" সমান "ক"), যদিও দুটি বস্তু কখনোই সম্পূর্ণরূপে সমান হতে পারে না। যখন এই টোলারেন্স অতিক্রম করা হয়, তখন পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়৷ অন্যকথায়, কোন বিয়ারিং নিম্নমানের বা সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
আমাদের বৈজ্ঞানিক চিন্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যক্রম বা অনুশীলনের একটি অংশ মাত্র। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কলা-কৌশলও। বিভিন্ন ধারণা বা প্রত্যয়ের সাথে জড়িত আছে আদর্শ মান থেকে বিচ্যুতি ও বিচ্যুতি "সহিষ্ণুতা"। এই 'সহিষ্ণুতা' ধারণাটি প্রথাগত যুক্তিবিদ্যা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় নি, যার মূল ভিত্তি “ক” সবসময়ই “ক” স্বতঃসিদ্ধটি। বরং দ্বান্দ্বিক যুক্তিপদ্ধতিই আদর্শ মান থেকে বিচ্যুতি ও এর সাথে জড়িত “সহিষ্ণুতা”-র ধারণাকে কার্যকরভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, কারণ এই চিন্তাপদ্ধতির ভিত্তি হলো এই অনুমান যে, সবকিছুই সবসময় পরিবর্তিত হচ্ছে।
প্রচলিত চিন্তাধারায় পুঁজিবাদ, নীতি-নৈতিকতা, শ্রমিক রাষ্ট্র, স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রত্যয়কে অপরিবর্তনীয় ধারণা বা বিমূর্তন মনে করা হয়। এই চিন্তা পদ্ধতি ধরে নেয় যে, পুঁজিবাদ সর্বত্র সর্বস্থানে একইভাবে কাজ করে বা যেকোনো নৈতিকতা বা মূল্যবোধের প্রকৃতি সর্বত্র সর্বাবস্থায় একই রকম। দ্বান্দ্বিক চিন্তা সকল বস্তু ও প্রপঞ্চকে তাদের ধারাবাহিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করে। একইসাথে এইসব রূপান্তরের ক্ষেত্রে নির্ধারণী ভূমিকা পালনকারী বস্তুগত অবস্থা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিরূপণ করে সেই তাৎপর্যপূর্ণ সীমা, যা অতিক্রম করলে “ক” সমান আর “ক” থাকে না বা একটি শ্রমিক রাষ্ট্র আর শ্রমিক রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজ করে না।
প্রচলিত চিন্তাধারায় প্রোথিত সবথেকে মৌলিক ত্রুটি হলো এই চিন্তাপদ্ধতি বাস্তবতাকে অপরিবর্তনীয় রূপে তুলে ধরে, যে বাস্তবতা আসলে চিরন্তন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। দ্বান্দ্বিক চিন্তা আরো স্পষ্ট মূল্যায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন তত্ত্বীয় ধারণা বা প্রত্যয়ে যুক্ত করে সংশোধন, অধিকতর মূর্ততা, অধিকতর সমৃদ্ধ বিষয়বস্তু ও পরিবর্তনশীলতা; আমি এক্ষেত্রে "প্রাণবন্ততা"-র কথাও বলবো, যা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের জীবন্ত প্রপঞ্চের কাছাকাছি নিয়ে যায়৷ যেমন: তারা পুঁজিবাদকে অভিন্ন ও সর্বজনীন হিসেবে না দেখে, দেখবে সামাজিক বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে কিভাবে একটি নির্দিষ্ট ধরণের পুঁজিবাদ বিদ্যমান থাকে৷ অথবা তারা " শ্রমিক রাষ্ট্র" সম্পর্কে কোন অনৈতিহাসিক সাধারণীকরণ না করে এই প্রপঞ্চকে দেখবে এক বিশেষ প্রেক্ষিতে (হয়তো তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখবে একটি অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে পশ্চাৎপদ শ্রমিক রাষ্ট্র হিসেবে, যা সাম্রাজ্যবাদী বেষ্টনীতে বন্দী)।
প্রচলিত চিন্তাধারার সাথে দ্বান্দিক চিন্তাধারা অনেকটা একটা স্থবির ফটোগ্রাফের সাথে চলচ্চিত্র যেমন সম্পর্কিত, তেমন সম্পর্কযুক্ত। চলচ্চিত্র স্থবির আলোকচিত্রকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে না, বরং পরিবর্তনের নীতি অনুযায়ী কতগুলো স্থবির আলোচিত্রকে একত্রিত করে। একই ভাবে, দ্বন্দ্বের নীতি সাধারণ যুক্তিবাক্যকে (সিলোজিজম) অস্বীকার করে না, বরং আমাদেরকে সিলোজিজমগুলোকে এমনভাবে একত্রিত করতে শিখায়, যা জগৎ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে সদা পরিবর্তনশীল বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে আসে। হেগেল তার 'লজিক' গ্রন্থে যুক্তি বিষয়ক কিছু সাধারণ নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন: পরিমাণে পরিবর্তনের ফলে গুনগত অবস্থার রূপান্তর, দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বিকাশ, বিষয় ও রূপের (আকার) দ্বন্দ্ব, ধারাবাহিকতার বিরতি, সম্ভাবনা থেকে অবশ্যম্ভাবিতায় রূপান্তর ইত্যাদি। এই সাধারণ নীতিগুলো তাত্ত্বিক চিন্তার জন্য ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতোটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ের চিন্তাভাবনার জন্য অ্যারিস্টোটলীয় যুক্তিবাক্য।
হেগেল ডারউইন ও মার্ক্সের আগমনের পূর্বে লিখেছেন। ফরাসি বিপ্লবের ফলে বৌদ্ধিক চিন্তায় যুক্ত হওয়া শক্তিশালী প্রেরণার বদৌলতে হেগেল বিজ্ঞানের সাধারণ গতিবিধি অনুমানে সক্ষম হয়েছিল। তবে, যেহেতু এই চিন্তা একটি পূর্বানুমানের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই এটা হেগেলের থেকে একটি ভাববাদী বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। হেগেল ভাববাদী ছায়াকে চূড়ান্ত বাস্তবতা মনে করে তার দর্শন তৈরি করেছিলেন। মার্ক্স অবশ্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হন যে, এই ভাবাদার্শিক ছায়া বস্তুগত অবস্থার প্রতিফলন মাত্র৷
আমরা আমাদের দ্বান্দিকতাকে বস্তুবাদী বলি, কারণ এই দ্বান্দিকতার শিকড় স্বর্গে বা আমাদের 'স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি'-র মাঝে অবস্থিত নয়। বরং এই দ্বান্দিকতার আদি ভিত্তি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা ও প্রকৃতি। চেতনার জন্ম অচেতন থেকে; মনস্তত্ত্বের জন্ম শারীরবিধান থেকে; জৈব দুনিয়ার জন্ম অজৈবিকতা থেকে; নীহারীকা থেকে এসেছে সৌরজগত। বিকাশের সকল ধাপে সংখ্যাগত পরিবর্তন গুনগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়। আমাদের চিন্তা (যার মধ্যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অন্তর্ভুক্ত) পরিবর্তনশীল বস্তুর আত্মপ্রকাশের একটি রূপ মাত্র। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ঈশ্বর অথবা শয়তান, অমর আত্মা অথবা চিরন্তন নীতি ও নৈতিকতার কোন স্থান নেই। কাজেই প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা থেকে উদ্ভুত এই পদ্ধতি একটি বস্তুবাদী আকার ধারণ করে।
প্রজাতির বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেছে সংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে তৈরি গুনগত রূপান্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে ডারউইনবাদ।এটি জৈব পদার্থের শাস্ত্রে দ্বান্দ্বিক চিন্তা পদ্ধতির সর্বোত্তম প্রতিফলন৷ দ্বান্দ্বিক চিন্তা পদ্ধতির আরেকটি বড় সফলতা ছিল রাসয়নিক উপাদান সমূহের আনবিক ভরের টেবিল তৈরি ও পরবর্তীতে একটি উপাদানের আরেকটি উপাদানে রূপান্তরের সাধারণ নীতি আবিষ্কার।
এই সকল রূপান্তরের (প্রজাতি, রাসয়নিক উপাদান ইত্যাদি) সাথে জড়িত শ্রেণিকরণের প্রশ্ন, যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লিনিয়াসের তাত্ত্বিক কাঠামো (আঠারো শতকে) বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে উদ্ভিদের বিবরণ ও শ্রেণিকরণ প্রদান করেন। এই তাত্ত্বিক প্রতিচিত্রে লিনিয়াসের প্রাথমিক স্বতঃসিদ্ধ ছিল প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তা। উদ্ভিদবিদ্যার এই অপরিণত যুগ এরিস্টোটলীয় যুক্তির অপরিণত অবস্থার সাথে তুলনীয়। প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তা নামক ধারণাটির চূড়ান্ত প্রত্যাখান এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও তাদের দৈহিক কাঠামোর বিবর্তনের ইতিহাস অধ্যায়নই শুধুমাত্র প্রকৃত বৈজ্ঞানিক শ্রেণিকরণ সম্ভব করে তুলেছিল৷
একজন সচেতন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হিসেবে (যা ডারউইন নয়), মার্ক্স মানব সমাজ সমূহের বৈজ্ঞানিক শ্রেণিকরণের সাধারণ নীতি আবিষ্কার করেছিলেন। মার্ক্সের কাছে, শ্রেণিকরণের ভিত্তি ছিল কোন একটি সমাজের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ও সেখানে বিদ্যমান মালিকানা সম্পর্কের কাঠামো, যা একটি সমাজের মৌলিক গঠনতন্ত্র নির্মাণ করে। মার্ক্সবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থুল বর্ণনামূলক শ্রেণিকরণকে ( যা এখনো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ধারণা) একটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী শ্রেণিকরণ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে৷
আমরা দেখতে পাই যে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে অধিবিদ্যা বা মধ্যযুগীয় স্থবির চিন্তা পদ্ধতির (স্কলাস্টিসিজম) কোন জায়গা নেই। এই ধরণের চিন্তাপদ্ধতি আত্মাহংকারী অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। দ্বান্দ্বিক যুক্তি সমকালীন বৈজ্ঞানিক চিন্তায় উপস্থিত পরিবর্তনের নীতিকেই প্রকাশিত করে৷ অন্যদিকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতি উন্মত্ত বিরোধীতা প্রকাশ করে এক সুদূর অতীতের প্রতি বিশ্বাস, পেটি-বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলতা, বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষণশীলদের আত্ম-অহমিকা এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য একধরণের আশার স্ফুলিঙ্গ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃতি
কমরেড বার্নহ্যাম সোভিয়েত ইউনিয়নকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন ("শ্রমিক রাষ্ট্রও না, বুর্জোয়া রাষ্ট্রও নয়") তা সম্পূর্ণরূপে নেতিবাচক। বার্নহ্যামের সংজ্ঞা ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাধারণ নীতি থেকে বিছিন্ন, যেন শুণ্যে দোদুল্যমান ভিত্তিহীন কোন কিছু। বার্নহ্যামের সংজ্ঞায় সমাজবিজ্ঞানের ছিটেফোটাও নেই এবং এই সংজ্ঞা একটি স্ববিরোধী ঐতিহাসিক প্রপঞ্চের সামনে প্রয়োগবাদের আত্মসমর্পনকেই প্রতিনিধিত্ব করে।
যদি বার্নহ্যাম একজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হতেন, তবে তিনি এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেনঃ ১) সোভয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিক উৎপত্তি কী ও কেমন ছিল? ২) নিজের অস্তিত্বকালে এই রাষ্ট্র কি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে? ৩) এই পরিবর্তনগুলোর প্রভাব কি সংখ্যাগত ধাপ থেকে গুনগত ধাপে রূপান্তরিত হয়েছে? অর্থ্যাৎ এই পরিবর্তনগুলো কি একটি নতুন শোষক শ্রেণির ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে? যদি বার্নহ্যাম এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেন, তবে তিনি বাধ্য হতেন একমাত্র সম্ভাব্য উপসংহারে পৌছাতে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনো একটি বিপথগামী শ্রমিক রাষ্ট্র।
দ্বান্দ্বিকতার সাধারণ নীতি দুনিয়ার সকল প্রশ্ন সমাধানের কোন জাদুর কাঠি নয়, যা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের স্থান দখল করতে সক্ষম৷ তবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে সক্ষম, যা বিষয়ীবাদ (সাবজেক্টিজম) ও মধ্যযুগীয় জ্ঞানাহরণ পদ্ধতির (স্কলাস্টিসিজম) মরুভূমিতে অফলপ্রসু বিচরণ থেকে বিশ্লেষণকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করে।
ব্রুনো আর উভয় সোভিয়েত ও অন্যান্য ফ্যাসিস্ট শাসনব্যাবস্থাকে 'আমলাতান্ত্রিক সামষ্টিকতাবাদ' নামক বর্গের অন্তর্ভুক্ত করেছেন৷ কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও ইতালি--- তিনটি রাষ্ট্রই আমলাতন্ত্র দ্বারা শাসিত; উভয় কমিউনিস্ট ও ফ্যাসিস্ট শাসনে পরিকল্পনা ভিত্তিক অর্থনীতির (প্লানড ইকোনোমি) সাধারণ নীতি বিদ্যমান; একস্থানে, কোনো ব্যক্তি সম্পত্তিই নেই, অন্যত্র, ব্যক্তি সম্পত্তি সীমাবদ্ধ৷ ভিন্ন উৎপত্তি, ভিন্ন গুরুত্ব ও ভিন্ন শ্রেণি তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন ধরণের শাসন ব্যবস্থার একটি মৌলিক পরিচিতি তিনি তৈরি করেছেন। এটা অবশ্য বুর্জোয়া অধ্যাপকদের স্বভাবসুলভ কাজেরই অংশ, যারা বিভিন্ন শাসন ব্যবস্থার মৌলিক শ্রেণি প্রকৃতিকে বিবেচনা না করেই 'নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি', 'কেন্দ্রায়ত রাষ্ট্র' -এর মতো বর্গ নির্মাণ করেন। এর মাধ্যমে ব্রুনো আর তার অনুসারীরা অথবা বার্নহ্যামের মতো আধা অনুসারীরা সামাজিক শ্রেণিকরণে লিনিয়াসের পর্যায়ভুক্ত, যদিও লিনিয়াসের ক্ষেত্রে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনি হেগেল, ডারউইন ও মার্ক্সের আগে জন্মেছিলেন।
আরো খারাপ ও অধিক ভয়ংকর হলো ওইসব সারগ্রাহী ব্যক্তিগণ, যারা মনে করেন, সোভিয়েত রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র "প্রাসঙ্গিক কোন বিষয় নয়" এবং আমাদের পলিসির গতিপথ নির্ধারিত হবে "যুদ্ধের প্রকৃতি" দ্বারা। তারা এমনভাবে তত্ত্ব নির্মাণ করে যাতে মনে হয় যুদ্ধ একটি স্বাধীন অতি-সামাজিক উপাদান, যুদ্ধের প্রকৃতি যেন শাসক শ্রেণির চরিত্র দ্বারা নির্ধারিত হয় না! অর্থ্যাৎ যে সামাজিক নির্ধারনী উপাদান রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণয় করে দেয়, সেটা যুদ্ধের প্রকৃতিও নির্ধারণ করে। বিস্ময়কর যে, ঘটনাপ্রবাহের চাপে কতো সহজেই কিছু কমরেড মার্ক্সবদের অ আ ক খ ভুলে যায়৷
এটা আশ্চর্যজনক নয় যে, যেসব বিরোধীদলীয় তাত্ত্বিকরা দ্বান্দ্বিক চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ববিরোধী প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে, বিপ্লবের ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক ভিত্তি এবং বিপ্লবের অধঃপতন থেকে উত্থিত (আমলাতান্ত্রিক) সম্প্রদায়ের চরিত্রের মাঝের দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র একটি অখণ্ডনীয় ঐতিহাসিক সত্যই নয়, এই দ্বন্দ্ব ইতিহাসের এক চালিকা শক্তিও বটে। আমলাতন্ত্র উচ্ছেদের সংগ্রামে আমরা নিজেদেরকে এই দ্বন্দ্বের উপরে স্থাপিত করি। এদিকে কিছু অতি-বামরা ইতিমধ্যে এক চূড়ান্ত অর্থহীনতায় পৌছে গেছে, এটা ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে, বোনাপার্টীয় সংখ্যালঘুতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সামাজিক কাঠামোকে বিসর্জন করা দরকার! তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, অক্টোবর বিপ্লবের ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক কাঠামো বিহীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা বৈ আর কিছু হবে না।
বিবর্তন ও দ্বান্দিকতা
কমরেড বার্নহ্যাম সম্ভবত প্রতিবাদ করে এটা বলবেন যে, একজন বিবর্তনবাদী হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রগতি নিয়ে তিনি আমাদের মতো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের থেকে কম আগ্রহী নয়। আমরা তার এই যুক্তিকে খণ্ডণ করবো না; তিনি একজন 'বিবর্তনবাদী' হতেও পারেন। ডারউইন পরবর্তী প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তিই নিজেকে বিবর্তনবাদী হিসেবে দাবী করেছেন। তবে একজন প্রকৃত বিবর্তনবাদীকে অবশ্যই বিবর্তনের ধারণাকে নিজের চিন্তার বিন্যাসে প্রয়োগ করতে হবে। প্রাথমিক যুক্তি যা বিবর্তনবাদী ধ্যান-ধারণার উদ্ভবের আগে তৈরি হয়েছিল, তা বিবর্তনবাদী প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। হেগেলের যুক্তিই বিবর্তনের প্রকৃত যুক্তি। অবশ্য এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, বিবর্তন বলতে শান্তিপূর্ণ 'প্রগতি' বোঝাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উদারবাদী লেখকরা বিবর্তনের ধারণাকে দূষিত ও বিকৃত করে ফেলেছেন। যিনি বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে পরস্পরবিরোধী শক্তির দ্বন্দ্ব হিসেবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন; যিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, ধীর ও ছোট ছোট পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে পুরোনো খোলস ভেঙে ফেলে এবং সংঘটিত করে এক আকস্মিক রূপান্তর, যা বিপ্লব নামে পরিচিত; যিনি বিবর্তনের সাধারণ নীতিকে নিজের চিন্তায় প্রয়োগ করতে শিখেছে, তিনিই প্রকৃত দ্বান্তিক বিবর্তনবাদী এবং এই জ্ঞানই তাকে স্থুলমগজ বিবর্তনবাদীদের থেকে আলাদা করে তোলে। একজন পিয়ানিস্টের যেমন আঙুলের প্রশিক্ষণ দরকার, তেমন করে একজন সংগ্রামী বিপ্লবীর প্রয়োজন বিচারশক্তি বা চিন্তার দ্বান্দ্বিক প্রশিক্ষণ। চিন্তার দ্বান্দ্বিক প্রশিক্ষণ দাবী করে, স্থির বর্গ হিসেবে না দেখে সকল সমস্যাকেই প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷ অন্যদিকে, স্থুলমগজ বিবর্তনবাদীরা শুধু কিছু স্তরকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিবর্তনকে স্বীকার করে, অন্যান্য বেশীরভাগ প্রশ্নে তাদের উত্তর 'কমন সেন্স'-এর গতানুগতিকতার মাঝেই সীমাবদ্ধ৷